১৪ বছর বয়সেই আইপিএল অভিষেক
ক্রীড়া প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৫ ০৫:৪১ পিএম
ইতিহাস গড়লেন বৈভব সূর্যবংশী
টিভির পর্দায় যখন ভেসে উঠছিল ১৪ বছর ২৩ দিন বয়স, তখনও অনেকের চোখ বিশ্বাস করতে পারছিল না। সত্যিই কি সম্ভব? এমন কিশোর, এমন বালক, এত বড় মঞ্চে! আর সেই সংশয় দূর হতে সময় লাগল মাত্র চার বল। আইপিএলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর একটি রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে লখনউ সুপার জায়ান্টসের বিপক্ষে যখন ব্যাট হাতে মাঠে নামলেন বৈভব সূর্যবংশী, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, এত চাপ সামলাবে কীভাবে? অথচ ঠিক প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই এক্সট্রা কভার দিয়ে বিশাল ছক্কা! যেভাবে বলে ব্যাট নামিয়েছিলেন, যেভাবে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন তা একেবারেই নবাগত কারও ব্যাটিং নয়। ওটা ছিল সাহসের, ওটা ছিল আত্মবিশ্বাসের, আর সবচেয়ে বড় কথা ওটা ছিল ভবিষ্যতের আভাস এক।
প্রথম ম্যাচেই ২০ বলে ৩৪ রানের ঝড়ো ইনিংস। ৩টি ছক্কা, ২টি চার। ওপেনার ইয়াশাসভি জয়সওয়ালের সঙ্গে ৮৫ রানের জুটি। ম্যাচটি রাজস্থান রয়্যালস মাত্র দুই রানে হারলেও, সূর্যবংশী জয় করে নিয়েছেন সকলের মন। আর তাতেই ইতিহাস আইপিএলের সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেককারী ক্রিকেটার হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে ভেঙে দেন প্রায়াস রায় বর্মণের রেকর্ড (১৬ বছর ১৫৭ দিন)। তবে এই গল্পটা কেবল একটা ছক্কা বা একটি রেকর্ড নয়। এর পেছনে আছে বছরজুড়ে ছুটে চলা, বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পরিপক্বতা, আর এক প্রবল প্রতিভার জন্ম কাহিনি।
জন্ম এক বিস্ময়ের: ১২ বছরেই রঞ্জি, ১৩-তে টেস্ট সেঞ্চুরি! বৈভব সূর্যবংশীর নাম ক্রিকেটপ্রেমীদের কানে নতুন হলেও, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের ভক্তদের কাছে তিনি বহুদিন ধরেই এক বিস্ময়ের নাম। মাত্র ১২ বছর ২৮৪ দিন বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক করে তিনি হন এই প্রতিযোগিতার ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়। প্যাড, হেলমেট, গ্লাভস সবই তার শরীরে ছিল বয়সের তুলনায় বড়, কিন্তু যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি ক্রিজে দাঁড়িয়েছিলেন, তা যে কোনো সিনিয়র ব্যাটারের মুখে হাসি এনে দিতো। এরপর একের পর এক বিস্ময়। ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে গিয়েও তিনি থেমে থাকেননি।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে যুব টেস্টে মাত্র ৬২ বলে শতরান, যা তাকে এনে দেয় দ্বিতীয় দ্রুততম যুব শতকের রেকর্ড। সেই ইনিংসের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর ১৮৭ দিন। ওই ম্যাচেই তিনি ভেঙে দেন বাংলাদেশের নাজমুল হোসেন শান্তর সবচেয়ে কম বয়সে যুব টেস্টে শতরান করার রেকর্ড। ভাবা যায়? বয়স যেখানে স্কুলের বই-খাতা নিয়ে ডুবে থাকার কথা, সেখানে সে বয়সেই আন্তর্জাতিক যুব টেস্টে এমন নজরকাড়া কীর্তি! ১৭৮ বলে ৩৩২ রান! এক ইনিংসে বিস্ফোরণ বিহার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এক ইনিংসে ১৭৮ বলে ৩৩২ রান, যেখানে ছিল ৪৮টি চার ও ১৫টি ছক্কা এই ইনিংস যেন রীতিমতো রূপকথার মতো। মাঠজুড়ে শুধুই সূর্যবংশীর তাণ্ডব। সেই দিন থেকেই বোঝা যায়, এই ছেলেটা ‘সাধারণ’ কিছু নয়। শুধু ব্যাটিং নয়, ফিটনেস, ফোকাস, আর ম্যাচ রিডিং স্কিলও ছিল চোখে পড়ার মতো। আর এইসব গুণই তাকে নিয়ে এসেছে আইপিএলের দরজায়।
৩০ লাখ থেকে ১.১০ কোটি নিলামে বাজিমাত: ২০২৫ আইপিএল নিলামে সূর্যবংশীর ভিত্তিমূল্য ছিল মাত্র ৩০ লাখ রুপি। তবে রাজস্থান রয়্যালস তাকে নিয়ে নেয় ১ কোটি ১০ লাখে, বোঝাই যাচ্ছে, তাদের ভরসা ছিল এই কিশোর বিস্ময়ের ওপর। সঞ্জু স্যামসনের ইনজুরির কারণে সুযোগ আসে হঠাৎ করেই, তবে সে সুযোগকে তিনি রূপ দিলেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
সীমাবদ্ধতা এখনো আছে কিন্তু সময় তার হাতে: স্বীকৃত ক্রিকেটে এখনও খুব বেশি সফল নন সূর্যবংশী। প্রথম শ্রেণিতে ৫ ম্যাচে করেছেন মাত্র ১০০ রান, লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ৬ ম্যাচে করেছেন ১৩২ রান। আইপিএলে এই ম্যাচসহ টি-টোয়েন্টিতে খেলেছেন মাত্র ২টি ম্যাচ। পরিসংখ্যান এখনো তার পক্ষে কথা বলছে না। কিন্তু ক্রিকেটের ইতিহাস বলে সব কিংবদন্তির শুরু হতো এক ঝলক আলো দিয়ে। বৈভব সূর্যবংশী সেই আলোটা দেখিয়ে দিয়েছেন।
ভবিষ্যতের পথে সূর্য ওঠা শুরু: এই বয়সে এমন আত্মবিশ্বাস, এমন কভার ড্রাইভ, এমন শরীরী ভাষা খুব কমই দেখা যায়। তার শট সিলেকশন, পায়ের ব্যবহার, ফিল্ডারদের গ্যাপে বল পাঠানোর দক্ষতা সব কিছুতেই স্পষ্ট পরিণত মস্তিষ্কের ছাপ। যেভাবে তার ক্যারিয়ার গড়ে উঠছে, তাতে মনে হচ্ছে, ভারত ভবিষ্যতে হয়তো আরও এক বিরাট কোহলি কিংবা শুভমান গিলকে পাবে, কিন্তু তার চেয়েও অল্প বয়সে! অবশ্যই, সামনে আরও কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে স্পিনারদের বিপক্ষে ধৈর্য, বিদেশের কন্ডিশনে ব্যাটিং, বড় ম্যাচে চাপ সামলানো। কিন্তু সূর্যবংশীর হাতে সময় আছে, সামর্থ্য আছে, সাহস তো দেখিয়েই দিয়েছেন। ভবিষ্যতের ক্রিকেট ইতিহাস লিখতে হয়তো কলম নয়, ব্যাটই তুলে নিয়েছেন বৈভব সূর্যবংশী। বয়স তার বাধা নয়, বরং শক্তি। শুধু সময়ই বলে দেবে, এই বিস্ময় কতটা দূর যেতে পারে। তবে আজ যা হলো তা ইতিহাসে লেখা থাকবে রূপকথার পাতায়।
ভোরের আকাশ/এসএইচ