জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ২১ মে ২০২৫ ০৩:০৮ পিএম
নরসুন্দরের ঐতিহ্যের স্মৃতি
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার মল্লিকবাড়ী বাজার। সপ্তাহে একদিন- শনিবার এই বাজারে বসে জমজমাট হাট। হাটের সবচেয়ে চিরচেনা ও ব্যতিক্রমী দৃশ্যটি হল, বিশাল বটগাছের ছায়াতলে একদল নরসুন্দরের কর্মব্যস্ততা। যুগ বদলেছে, শহরের মোড় ঘুরলেই দেখা মেলে ঝলমলে আধুনিক মানের সেলুন। কিন্তু এখানকার অনেকে এখনো ছুটে আসেন এই বটতলার নরসুন্দরের কাছে- চুল-দাঁড়ি কাটাতে।
এই বটগাছের ছায়াতলে নরসুন্দরের কাজে কেউ কেউ পার করেছেন জীবনের অর্ধশতাব্দীও। ত্রিশাল উপজেলার বগারবাজার এলাকার সত্তর বয়সী রায়মন চন্দ্র শীল বলেন, ‘আমি পাকিস্তান আমল থেকেই কাজ করছি। তখন হাতে কাজ থাকতো, পকেটে টাকা থাকতো। রায়মন চন্দ্র শীল জানান, এখনো হাটের দিনে এই বটগাছের নিচে কাজ করেন, বাকি দিন গ্রামে ঘুরে ঘুরে কাজ করেন। আগে দিনে সাত-আটশ টাকা রোজগার হতো, এখন পাঁচশও হয় না।
ভালুকার তামাট গ্রামের ইন্দ্রমোহন (৭০) প্রায় দেড় যুগ ধরে এই হাটে নরসুন্দর এর কাজ করছেন। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘আগে হাটের দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হতো, এখন সেই জৌলুস নেই।’
তবে তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ এখনো এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। পাঁচগাঁও হাজিরবাজারের সুমন শীল (২৪) নিজের গ্রামে একটি সেলুন পরিচালনা করেন। তবুও প্রতি শনিবার চলে আসেন মল্লিকবাড়ী হাটে। তার ভাষায়, ‘এখানে একটা টান আছে, খদ্দেররাও পরিচিত। পরিবেশটা যেন আপন হয়ে গেছে।’
স্থানীয় প্রবীণ নরসুন্দর নুর মোহাম্মদ (৭৩) জানালেন, মাত্র ১০ বছর বয়সে এই বাজারে নরসুন্দর হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। আজও এই পেশা ধরে রেখেছি। বললেন, আগে সকাল থেকেই সারি করে খদ্দের বসতো। এখন আর সেই ভিড় নেই, তবে প্রতিদিন গড়ে পাঁচশো টাকা আয় হয়।”
৯০ বছর বয়সী নিয়মিত ফয়েজ উদ্দিন বলেন, “অনেক বছর ধরেই এখানেই চুল-দাঁড়ি কাটাই। সেলুনে গেলে খরচ বেশি হয়, এখানে কম খরচে ভালো কাজ হয়।”
এই বটগাছ, পুরনো কিছু আয়না আর একজোড়া কাঁচির মধ্যে এখনো টিকে আছে এক ঐতিহ্যবাহী পেশা। মল্লিকবাড়ী বাজারের এই নরসুন্দর হাট শুধু একটি পেশাভিত্তিক কেন্দ্রবিন্দু নয়- এটি একেকটি জীবনের গল্প, লোকজ সংস্কৃতির জীবন্ত স্মারক।
প্রতি শনিবার বসা এই হাট বহু পরিবারের জীবিকার উৎস এবং অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বপ্ন। ডিজিটাল যুগে আধুনিকতার ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসা এই ঐতিহ্য এখনো ধুকে ধুকে বেঁচে আছে মানুষের স্মৃতি, মমতা আর প্রয়োজনের তাগিদ থেকে। এমনটাই মনে করেন স্থানীয়রা।
ভোরের আকাশ/আজাসা