ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৫ ০৯:৫৪ এএম
পদত্যাগ করাতে হাসিনার পা ধরেছিলেন রেহানা
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করাতে পা জড়িয়ে ধরেছিলেন তারই ছোট বোন শেখ রেহানা। গণভবনে গিয়ে গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পা ধরেছিলেন শেখ রেহানা। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা এক তদন্ত প্রতিবদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল ওই প্রতিবেদন পাঠ করেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় গত বছর ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যার ঘটনার মামলায় বিচারের জন্য দাখিল করা আনুষ্ঠানিক অভিযোগের (ফরমাল চার্জ) স্বপক্ষে এই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল রোববার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। এই ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এদিকে আদালত অবমাননার মামলায় শেখ হাসিনা ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাকিল আলম বুলবুলকে হাজির হতে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি জারি করতে নির্দেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের সামনে চানখাঁরপুলে গুলি করে ছয়জনকে হত্যার ঘটনার মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শেষ সময়েও অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং আরও রক্তপাতের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
দেশ ছাড়ার আগে ৪ আগস্ট সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় এক ঘণ্টা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের চাপ দিয়েছিলেন তিনি। তবে পরিস্থিতি যে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেটা তিনি কিছুতেই মানতে চাচ্ছিলেন না। ওবায়দুল কাদের, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, আছাদুজ্জামান খান কামাল তাকে পদত্যাগ করতে না করেছিলেন।
শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পরিবারের সদস্যরা তাকে বোঝানোর পর তিনি পদত্যাগে রাজি হন। এরপর দ্রুততম সময়ে পদত্যাগ করে শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে গোপনে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা।’
হাসিনার বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারির নির্দেশ
ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এখনও তিনি ভারতেই অবস্থান করছেন। সেখান থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছেন। আর সেই কথার অডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে।
এরকমই একটি রেকর্ডে একজনের সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে একটি নারীকণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, সারা দেশে তার নামে ২২৬টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি ২২৬টি হত্যার লাইসেন্স পেয়েছেন। কারণ, একটি হত্যা মামলায় যে সাজা, দুইশ’র বেশি হত্যা মামলায়ও সেই সাজা। অভিযোগ ওঠে ওই বক্তব্য শেখ হাসিনার। এরপর তা ট্রাইব্যুনালে নজরে আনা হয়।
ট্রাইব্যুনালে নির্দেশে অডিও রেকর্ডের বক্তব্যটি শেখ হাসিনাই তা সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত করা হয়। এর ভিত্তিতে গত ৩০ এপ্রিল শেখ হাসিনা এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি শাকিল আলম বুলবুলের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপন করে প্রসিকিউশনপক্ষ।
বলা হয়, এই বক্তব্যের মাধ্যমে আসামি শেখ হাসিনা বিচারপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুলিশ ও মামলার সাক্ষীদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন। এই অভিযোগের পর ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনা ও শাকিলকে ১৫ মে’র মধ্যে লিখিত জবাব দাখিলের নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জবাব না দেওয়ায় দুই আসামিকে ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। তবে তারা হাজির হননি। এমন পরিস্থিতিতে তাদের ৭ দিনের মধ্যে হাজির হতে দুটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি জারি করতে ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৩ জুন দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছর ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ডাকা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেটার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং দিয়ে দিচ্ছেন, সামরিক যানে পর্যন্ত উঠে পড়ছেন- এরপরও কেন তারা কঠোর হচ্ছে না, সেটা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা আইজিপিকে দেখিয়ে বলেন, তারা (পুলিশ) তো ভালো করছে। তখন আইজিপি বলেন, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এ রকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়। ওই সময়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, বলপ্রয়োগ করে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না।
কিন্তু শেখ হাসিনা সেটা মানতে চাচ্ছিলেন না। তখন কর্মকর্তারা শেখ রেহানার সঙ্গে আরেক কক্ষে আলোচনা করেন। তাকে পরিস্থিতি জানিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা এরপর বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। পা জড়িয়ে ধরে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে বলেন তিনি। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
এরপর জয় তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। রাজি হয়ে যান পদত্যাগে। তিনি তখন একটা ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য। ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য আসে যে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা শাহবাগ ও উত্তরা থেকে গণভবন অভিমুখে রওনা হয়েছে। দূরত্ব বিবেচনায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে শাহবাগ থেকে গণভবনে আন্দোলনকারীরা চলে আসতে পারে বলে অনুমান করা হয়।
ভাষণ রেকর্ড করতে দিলে গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় নাও পাওয়া যেতে পারে। এরপর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে আসেন শেখ হাসিনা। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেন শেখ হাসিনা।
ভোরের আকাশ/এসএইচ